মুদ্রারাক্ষস মুদ্রাস্ফীতি,বিটকয়েন ও ব্লকচেন PDF | শিশির ভট্টাচার্য্য

মুদ্রারাক্ষস মুদ্রাস্ফীতি,বিটকয়েন ও ব্লকচেন PDF | শিশির ভট্টাচার্য্য 

মুদ্রারাক্ষস মুদ্রাস্ফীতি,বিটকয়েন ও ব্লকচেন PDF | শিশির ভট্টাচার্য্য



চতুর্থ (মতান্তরে অষ্টম) শতকে বিশাখদত্ত রচিত সংস্কৃত ভাষার নাটক 'মুদ্রারাক্ষস' আর করোনা পরবর্তী সময়ের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইস্টিটিউটের অধ্যাপক, স্বনামধন্য লেখক এবং অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি সচেতন ব্যক্তিত্ব শিশির ভট্টাচার্য্য রচিত 'মুদ্রারাক্ষস' বইয়ে মুদ্রার ইতিহাস, অর্থনীতিতে মুদ্রার গুরুত্ব, ব্লকচেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেন এক মজলিশী ধাঁচে গল্প বলার মতো করে লেখা হয়েছে। মুদ্রা ও অর্থনীতির বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন ভাষার প্রবাদ-প্রবচন, গানের কলি, কবিতার লাইন, প্রচলিত সংলাপের মিশ্রণে মজার ছলে অনন্য সাধারণ পাঠ হলো 'মুদ্রারাক্ষস'। 

 
কীনসীয় অর্থনীতি, মার্ক্সীয় অর্থনীতি ও অস্ট্রীয় অর্থনীতি নিয়ে পরিচয় শেষে জন ম্যানার্ড কিনসের দেওয়া ধারণার সমালোচনা ও অস্ট্রিয়া ঘরানার অর্থনীতি বাস্তববাদী চিন্তা-ভাবনা নিয়ে আলোকপাত করা হয়। এই পুস্তকে অস্ট্রীয় স্কুলের আধুনিক অর্থনীতিবিদ লেবাননের সাইফুদ্দিন আম্মুস কর্তৃক রচিত 'বিটকয়েন স্ট্যান্ডার্ড' পুস্তক থেকে অস্ট্রীয় ঘরানার অর্থনীতির নীতি ও ধারণা নেওয়া হয়েছে। ব্লকচেন ও ক্রিপ্টোমুদ্রা সম্পর্কে লেখক তাঁর কিতাবে আলোচনা করেছেন। 
বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে প্রশান্ত মহাসাগরের মাইক্রোনেশিয়ার অন্তর্ভুক্ত প্রধান দ্বীপ য়াপ দ্বীপের রাই পাথর নিয়ে প্রাঞ্জল গল্প কাহিনি পাওয়া যায় দ্বিতীয় অধ্যায়ে। রাই পাথর বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হতো। 


পরবর্তী অধ্যায়ে বার্টার সিস্টেম বা দ্রব্য বিনিময় থেকে বের হয়ে আসার পর অনেক ধরনের বিনিময়ের মাধ্যম উদ্ভব হয়ঃ তামা, রূপা, লবণ, চা-পাতা, ঝিনুক, পুঁতি, ধুম্রশলাকা, সিল্ক, কড়ি, পেরেক, গরু, বার্লি, ভুট্টা, গাছের ছাল, বিভারের লোমশ চামড়া, পুঁতি, স্বর্ণ ইত্যাদি। ধাতব মুদ্রার প্রচলন কেন শুরু হলো সে সম্পর্কে বলা হয়েছে এই অধ্যায়ে। 


মুদ্রা কেমন হওয়া দরকার, মুদ্রার কী কী গুণ থাকা অত্যন্ত জরুরী এমন অনেক প্রশ্নের উত্তর খুজে পাওয়া যাবে চতুর্থ অধ্যায়ে। তামা ও রূপার চেয়ে স্বর্ণ মুদ্রা হিসাবে অধিকতর গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠার কারণ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। রিজার্ভ হিসাবে স্বর্ণ কতটুকু যুক্তিযুক্ত, বর্তমানে রাশিয়া স্বর্ণ রিজার্ভ কেন করছে- সে বিষয়ে সরল ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। 


'কাগজের মুদ্রা, ফিয়াট মানি এবং সরকারের ছাপাবাজি' নামক অধ্যায়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন ভূখন্ডের জন্মক্ষণে মার্কিন সরকার ও তার মিত্রদেশগুলো মিলে ফিয়াট মানির জন্ম দেয়। ফিয়াট মানি হচ্ছে ইচ্ছামতো সরকার মুদ্রা ছাপাচ্ছে বা বানাচ্ছে। স্বর্ণ রিজার্ভ না করে ঋণপত্র হিসাবে কাগজের নোটের প্রচলন তখন থেকেই শুরু হয়। 


ষষ্ঠ ও সপ্তম অধ্যায়ে অর্থের সংজ্ঞা এবং মুদ্রার প্রকারভেদ নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। মুদ্রাহীন,  ব্যাংকহীন জীবন কেমন হতে পারে উদাহরণ পাওয়া যায়। উত্তম, মধ্যম, মন্দ ও জঘন্য-এই চার ধরনের মুদ্রা হতে পারে। অস্ট্রীয় ঘরনার অর্থনীতিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, মন্দমুদ্রায় সর্বনাশ ডেকে আনে।  মন্দ মুদ্রা উত্তম মুদ্রা বাজার থেকে বের করে দেয়। মন্দ মুদ্রা মন্দ সমাজ সৃষ্টি করে। মন্দ মুদ্রা মানুষকে ভোগবাদী, সুখবাদী করে গড়ে তোলে। 


অষ্টম অধ্যায়ে ব্রিটন উডস সম্মেলন, মন্দাকালে করনীয়, কাগজের টাকার মূল সমস্যা, রিজার্ভ কী এবং ফিয়াট মানি ও মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা নিয়ে সবিস্তারে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে।  টাইম ভ্যালু অব মানি বা অর্থের সময়মূল্য নিয়ে এতো সহজ ভাষায় মুদ্রাস্ফীতি বর্ণনা করা হয়েছে যেন কোমলমতি ছাত্ররাও বুঝতে পারে। 


ঋণ ও সঞ্চয় এই দুইয়ের মধ্যে অর্থনীতির ভিত্তি কী হওয়া উচিত- এ বিষয়ে পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে । অস্ট্রীয় ঘরানার অর্থনীতিবিদদের মতে, টাইম প্রেফারেন্স বা ভোগবাসনা বিলম্বিত করে সঞ্চয় করলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জীবনটা সহজ হয়, ফলশ্রুতিতে সমাজ দিন দিন ধনী ও উন্নত হয়। অস্ট্রীয় ঘরনার অর্থনীতিবিদ লুদভিগ ফন মিজ এবং ফ্রিড্রিখ হায়েকের মতে, ভোগবিলাসী, মন্দাভাব নিয়ে আসার মূল কারণ ফিয়াট মানির মতো জঘন্য মুদ্রা এবং একটি চরিত্রহীন অর্থব্যবস্থা যা সঞ্চয় নয়, ঋণকে অর্থনীতির ভিত্তি বলে মনে করে। কীনসীয় অর্থনীতি আমাদের চার্বাক নীতি দিয়েছেঃ "যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পীবেৎ!" (যতকাল বাঁচবে,  সুখে বাঁচবে এবং ঋণ করে হলেও ঘি খাবে!) আমরা ভুলে যাচ্ছি, মূলধন মানেই বিনিয়োগ, বিনিয়োগ মানেই কর্মসংস্থান। অন্যদিকে, দিন আনে দিন খায়— তাদের সঞ্চয় করা সম্ভব হয় না বললেই চলে। গরিব আর মধ্যবিত্ত পরিস্থিতি নিয়ে ওমর খৈয়াম বলেছেন, "নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতা শুন্য থাক। দুরের বাদ্য শুনে কী লাভ মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।"   


বিকল্প মুদ্রা ও প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়ে দশম ও একাদশ অধ্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে। ব্লকচেন প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারের হাতে নয়, জনগণের হাতে মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হবে। ইথিরিয়াম, বিটকয়েনের মতো ক্রিপ্টোকারেন্সি হয়ে উঠতে পারে আগামী দিনের বিকল্প মুদ্রা। বাংলাদেশ একটি রক্ষনশীল দেশ যেখানে সরকার নতুন প্রযুক্তি ফার্স্ট হ্যান্ড ব্যবহার করতে চায় না, সেকেন্ড-থার্ড হ্যান্ড ব্যবহারকারী হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের নীতি ব্লকচেন সমৃদ্ধ বিটকয়েন সম্পর্কেও অপরিবর্তিত রয়েছে। সাবমেরিন ক্যাবল প্রথমে বিনা পয়সায় পাওয়ার সুযোগ থাকলেও গোপনীয় তথ্য ফাঁস হয়ে যাবার ভয়ে বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করেনি, কিন্তু পরবর্তীতে উইকিলিংকস থেকে জানা গেল সাবমেরিন ক্যাবল আসার অনেক আগেই সব ফাঁস হয়ে গেছে। বর্তমানে ব্লকচেন ব্যবহার কিছু কিছু ক্ষেত্রে চালু হলেও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বাংলাদেশ সরকার এখনো তীব্র রক্ষনশীলতার নীতি মেনে চলছে। বিটকয়েন ও ব্লকচেন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাতে দেখা গেছে ব্লকচেন প্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে বিটকয়েন মাইনিং করা হয়। উত্তর খুঁজে পাওয়া যাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি সম্পর্কিত আরো অনেক প্রশ্নের, ভবিষ্যতে ক্রিপ্টোমুদ্রার কী কী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে ইত্যাদি।  


দ্বাদশ অধ্যায় সম্মৃদ্ধ হয়েছে মুদ্রা, ভাষা ও ধর্ম মানব উদ্ভাবিত তিনটি সমজাতীয় প্রযুক্তি নিয়ে । বিবর্তন, উদ্ভাবন, বিলুপ্তি, বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় ভাষা ও ধর্মের ন্যায় মুদ্রার সময়কাল অতিবাহিত হয়। 
ত্রয়োদশ অধ্যায়ে আলোচনা করেছে কীভাবে শ্রমপাচার, মেধাপাচার, অর্থপাচার মন্দ অর্থ ব্যবস্থার কারনে হয়ে থাকে। রাজনৈতিক পরিবেশ উন্নত থাকলে অর্থনীতির উন্নতি ঘটে। সুশাসন ও সুবিচার দিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশের উন্নতি ঘটানো সম্ভব। এই অধ্যায় আমার নিজের মানসিক-সামাজিক সংকটের মূল কারণ অতি সহজে  তুলে ধরেছে। 


টাকায় সুখ আনে। টাকাই টাকা আনে। টাকাই কী না হয়! টাকা ছাড়া জীবন চলে না, আবার জীবনে টাকায় সব না। মন্দ অর্থ অনর্থের কারণ। এমন অনেক কথা প্রচলিত থাকলেও এতো সুন্দর সাবলীল বাংলায় অর্থনীতি ও মুদ্রা বিষয়ে বই পাবেন না বললেই চলে। সেজন্য বর্তমান সময়ে অর্থ বা মানি সম্পর্কে আরো পরিষ্কার ধারণা রাখার জন্য 'মুদ্রারাক্ষস' পাঠ করা জরুরী বলে মনে করি।



Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post

Contact Form