VAR কি? অফসাইড গোলের নতুন নিয়ম | অফসাইড কিভাবে হয়
VAR কি?
== Video Assistant Referee (VAR)
অফসাইডের ক্ষেত্রে আরো কম সময়ের মধ্যে আরো নিখুঁত সিদ্ধান্ত কিভাবে দেওয়া যায় এটা নিয়ে ফিফা গত তিন বছর ধরে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করছিল এবং সেই গবেষণার ফল হলো সেমি অটোমেটেড অফসাইড টেকনোলজি (SAOT)। SAOT হলো বিশেষ একধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেটি বল এবং খেলোয়ারদের শরীর থেকে আসা সংকেতগুলো সমন্বয় করে অফসাইডের একেবারে নির্ভুল সিদ্ধান্ত দিতে পারে এবং সেটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই। কোন খেলোয়ার অফসাইড হিসেবে গণ্য হবার সাথে সাথে SAOT প্রযুক্তি VAR রুমে থাকা রেফারিদের কাছে একটি বিশেষ সংকেত পৌছে দেয়। VAR রেফারি ম্যানুয়ালি ভিডিওটার রিপ্লে দেখে নিশ্চিত হয়ে মাঠের রেফারিকে অফসাইডের বার্তা পৌছে দেন।
এই পদ্ধতিটা আগে থেকে চালু থাকা VAR পদ্ধতির মতোই, শুধু পার্থক্য হলো আগে VAR রেফারিকে ম্যানুয়ালি অফসাইড লাইনটা টেনে দেখাতে হতো। এখন SAOT বিভিন্ন ক্যামেরা ও সেন্সর থেকে পাওয়া সংকেতগুলোকে সমন্বয় করে স্বয়ংক্রিয় এবং একেবারে নিখুঁত অফসাইড লাইন টেনে দিচ্ছে কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে। সেই সাথে অফসাইড পজিশনটার একটা স্বয়ংক্রিয় থ্রিডি অ্যানিমেশন দেখানো হয় মাঠের জায়ান্ট স্ক্রিনে এবং টিভির পর্দায়।
প্রশ্ন হলো SAOT কিভাবে কাজ করে? ফিফা জানাচ্ছে এবারের বিশ্বকাপে যে বলগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতিটি বলের একেবারে কেন্দ্রে একটি সেন্সর রয়েছে যেটি প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ বার সংকেত পাঠায় VAR কক্ষে। ৫০০ বার সংকেত পাঠানোর ফলে ঠিক যে মুহুর্তে বলটাকে পাস দেয়া হয়েছিল সেই মুহুর্তটা একেবারে নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা যায়। প্রচলিত VAR পদ্ধতিতে যেসকল ক্যামেরার মাধ্যমে অফসাইড ধরা হয় সেগুলো প্রতি সেকেন্ডে সর্বোচ্চ ৫০টা ফ্রেম তৈরী করতে পারে। কখনো কখনো দেখা যায় ঠিক যে মুহুর্তে বলটা পাস দেয়া হয়েছিল সেই মুহুর্তটা কোন নির্দিষ্ট ফ্রেমে একেবারে পরিস্কারভাবে ধরা পরেনি, সামান্য এদিক-ওদিক হয়ে যাচ্ছে।
তাই সেকেন্ডে ৫০ ফ্রেমের বদলে ৫০০টি পৃথক পৃথক সংকেত পাসিং এর মুহুর্তটাকে আগের চেয়ে আরো নির্দিষ্টভাবে দেখাতে পারে।
বলের পাশাপাশি মাঠের খেলোয়াদের শরীরের অঙ্গ সঞ্চালনের উপরেও খেয়াল রাখে SAOT। বিশ্বকাপের প্রতিটি স্টেডিয়ামের ছাদের নিচের দিকে ১২টি বিশেষ ক্যামেরা লাগানো আছে। ক্যামেরাগুলো অফসাইডের সন্দেহে থাকা আক্রমণকারী খেলোয়ার এবং প্রতিপক্ষের গোলকিপারের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ডিফেন্ডারের শরীরের ২৯টি জায়গা স্ক্যান করে। বলের ভেতরের সেন্সর থেকে পাঠানো সিগন্যাল এবং ক্যামেরার স্ক্যানিং এর সমন্বয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভুলভাবে ধরে ফেলে অফসাইডে থাকা খেলোয়ারকে।
প্রশ্ন উঠতে পারে SAOT প্রযুক্তিটি কতটুকু সঠিকভাবে অফসাইড ধরতে পারে? বলটি গোললাইন অতিক্রম করলো কিনা এ নিয়ে এক সময় বিতর্কের সুযোগ থাকলেও বর্তমানে গোললাইন টেকনোলজির মাধ্যমে শতভাগ নির্ভুল সিদ্ধান্ত রেফারি দিতে পারেন।
সাবেক ইতালিয়ান রেফারি এবং বর্তমানে ফিফার রেফারিজ কমিটির প্রধান পিয়েরেলুইজি কলিনা SAOT এর কার্যকারিতাকে গোললাইন প্রযুক্তির মতো নিঁখুত বলে বিবৃতি দিয়েছেন। বিশ্বকাপে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেবার আগে ফিফা আরব কাপ ২০২১ এবং ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ২০২১ টূর্ণামেন্ট দু’টিতে SAOT এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার করা হয়েছিল। দু’টো আসরেই SAOT এর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে।
তবে SAOT এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন, কখনো কখনো আক্রমণকারী দলের কোন খেলোয়ার অফসাইড পজিশনে থেকে নিষ্ক্রিয় থাকলেও গোলকিপারের দৃষ্টিসীমায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। সেক্ষেত্রেও এটি অফসাইড। কিন্তু SAOT প্রযুক্তি এধরনের অফসাইডকে চিহ্নিত করতে পারবে না।
এক নজরে SAOT এর সুবিধাগুলোঃ
• প্রচলিত ৫০ এফপিএস ক্যামেরার বদলে উন্নত সেন্সর ও বিশেষ ক্যামেরার ব্যবহার,
• রেফারি দ্বারা ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে টানা অফসাইড লাইনের বদলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে আরো সূক্ষ এবং স্বয়ংক্রিয় অফসাইড লাইন চিহ্নিত করা
• পূর্বের কয়েক মিনিটের বদলে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই নির্ভুল সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারা
বিজ্ঞান ভিত্তিক সমাধানঃ
সারা বিশ্ব এখন ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত। তবে বলি এবারের কাতার বিশ্বকাপ ফুটবলে যুক্ত হয়েছে Artificial Intelligence তথা কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ। সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের উৎকর্ষকে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগ আর কি! গোল দেওয়ার আগে প্লেয়ার অফসাইডে ছিল কিনা সেই সিদ্ধান্ত এখন কম্পিউটারের সাহায্যে নেওয়া হচ্ছে। এ কাজে VAR তথা Video Assistant Referee প্রযুক্তির সাথে আরো যুক্ত হলো SAOT তথা Semi Automated Offside Technology. বিশ্বকাপ ফুটবলের অফিসিয়াল বল হিসাবে ব্যবহৃত হয় এডিডাস এর তৈরী বলটি। এ প্রযুক্তিতে বলটির ভেতরে ঠিক কেন্দ্র বরাবর একটি মাইক্রোচিপ (মোবাইলের সিমের মতো) ব্যবহার করা হয়।
পাশাপাশি প্রত্যেকটি প্লেয়ারের বডিতেও অনুরূপ চিপ যুক্ত থাকে ফলে প্রতিটি খেলোয়াড়ের দেহের মোট 29টি পয়েন্ট থেকে প্রতিটি মুহুর্তে অর্থাৎ প্রতি 1 সেকেন্ডে 500 বার শরীরের মুভমেন্ট এর তথ্য সংগ্রহ হতে থাকে Artificial Intelligence এর কাজে ব্যবহৃত সেন্ট্রাল কম্পিউটারে (ছবি যুক্ত)। তাছাড়া স্টেডিয়ামের ছাদের নীচের অংশে অর্থাৎ মাঠের ভেতরের বিভিন্ন পয়েন্টে রয়েছে মোট 12টি Specialized Dedicated ক্যামেরা। সব মিলে এই সিস্টেমটি 1 সেকেন্ডের 500 ভাগের এক ভাগ সময়ে প্রতিনিয়ত ডাটা নিতে থাকে এবং কোন খেলোয়াড় অফসাইডে থাকলে এ সিস্টেম নিজে থেকেই (স্বয়ংক্রিয়ভাবেই) এলার্ম দিতে থাকে।
পরবর্তীতে মাঠের রেফারী যখনই এ সিস্টেমের সাহায্য নিতে চান তখনই রেডিমেইড হিসাবে রিপোর্ট আকারে তা পেয়ে যান তারা। ঠিক ক্রিকেটের এলবিডব্লিউর সিদ্ধান্তের মতো। আর সারা বিশ্বের ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা (FIFA) এ প্রযুক্তিকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করে 100% সফলতা পেয়েছেন এবং তার পরেই তা এবারের কাতার বিশ্বকাপে বাস্তবায়ন করেছেন।
VAR এর সাথে SAOT নিয়ে এক প্রস্থ
বিস্ময়ে হতবাক করে দেওয়া রেফারিং ভুলের স্বাক্ষী কম হয়নি ফুটবল বিশ্ব। ২০০২ বিশ্বকাপে দক্ষিণ কোরিয়ার বনাম স্পেন ম্যাচে রেফারির দেওয়া ভুল সিদ্ধান্তগুলোর কথা মনে করে দেখুন; বা ২০১০ বিশ্বকাপে জার্মানির বিপক্ষে পরিস্কার গোললাইন অতিক্রম করা ল্যাম্পার্ডের গোলটা বাতিল হয়ে যাওয়া; সেই বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের ডু অর ডাই ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে থিয়েরি অরির হাত দিয়ে করা এসিস্টে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ অংশগ্রহন নিশ্চিত করা; আর ’৮৬ বিশ্বকাপের সেই কুখ্যাত ‘হ্যান্ড অব দ্য গড’ তো আছেই। কি হতো যদি আজকের দিনের প্রযুক্তি তখন থাকতো? প্রযুক্তি কি নতুন করে লিখতো ফুটবল বিশ্বকাপের ইতিহাস?
প্রযুক্তির ছোঁয়া এখন প্রায় সব খেলাতেই লেগেছে। খেলার সূক্ষ সিদ্ধান্তগুলো আরো সঠিকভাবে প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্টরা বেছে নিচ্ছে উপযুক্ত প্রযুক্তি। ফুটবল খেলাটার ইতিহাসে এরকমই একটা সংযোজন ছিল ভিডিও এসিস্টেন্ট রেফারি (VAR)। ২০১০ এর দিকে ধারণাটা প্রথম নিয়ে আসে রয়্যাল নেদারল্যান্ডস ফুটবল এসোসিয়েশন (KNVB)। পরবর্তীতে ফিফা পর্যায়ক্রমে সেটি গ্রহন করে এবং ২০১৮ বিশ্বকাপ ফুটবলে VAR প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রযুক্তিটি নিয়ে কিছু সমালোচনা থাকলেও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনে VAR প্রযুক্তির কার্যকারিতা নিয়ে তেমন কোন প্রশ্ন উঠেনি। তবে VAR এর সমালোচনাও একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। বিশেষ করে সূক্ষ অফসাইডের মতো সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য প্রায় মিনিট খানেক খেলা থামিয়ে রাখায় সময়ের অপচয় এবং খেলার ছন্দপতনের অভিযোগের যথেষ্ট ভিত্তি ছিল।