সাম্প্রতিক ফোকাস রাইটিং - আসন্ন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং বাংলাদেশের করণীয়
সারা বিশ্বকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অস্থিরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক মন্দা, যুদ্ধ, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদিকে মােকাবিলা করতে হয়েছে। ২০২০ সালের শুরু থেকেই গােটা বিশ্ব কোভিড-১৯ নামক মহামারিতে আক্রান্ত। এ মহামারির প্রকোপে সারা বিশ্বের অর্থনীতি এখন মুখ থুবড়ে পড়ার মতাে অবস্থা। কোভিড-১৯-এর প্রকোপ থেকে সারা বিশ্ব বের না হতেই বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে যায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ যে। শুধুমাত্র দুটি দেশের মাঝে যুদ্ধ তা নয় বরং এটি এশিয়া-পশ্চিমা বিশ্বের যুদ্ধ। মূলত করােনা মহামারি, এ যুদ্ধ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এসবের ধকল ছােট-বড় সকল অর্থনীতির দেশকে পােহাতে হচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাহিরে নয়। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দার দিকে যাচ্ছে গােটা বিশ্ব।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বর্তমান অবস্থা এবং আসন্ন মন্দার আভাস:
আন্তর্জাতিক অনেক আর্থিক সংস্থা ইতিমধ্যে ভবিষ্যদ্বানী করেছে যে বিশ্ব অর্থনীতি ভয়াবহ মন্দার দিকে ধাবিত হচ্ছে। অর্থনীতির মূল তিন চালিকা শক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউর েপের অর্থনীতি চরম লাজুক অবস্থায় রয়েছে। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দাক্রান্ত হয়ে পড়েছে যদিও দেশটি তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি। মার্কিন জনগণ তাদের ভােগ ব্যয় কমিয়ে দিলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। দেশটির বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি সবশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী ৯.১% অতিক্রম করে গেছে। যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মুদ্রাস্ফীতি। ইউরােপীয় ইউনিয়নের দেশগুলাের গড় মুদ্রাস্ফীতির হার ৮শতাংশের উপরে।
নিকট ভারতের অবস্থাও বেশ খারাপ। দেশটির বৈদেশিক রিজার্ভ দিন দিন কমছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ২.৫% এবং ২০২৩ সালে তা নেমে আসতে পারে ২.২% তে। আগামী দিনে বিশ্ব অর্থনীতিতে খাদ্যপণ্যে মূল্যস্ফীতি অনেক দেশের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হবে। করােনা প্রকোপ ছাড়াও রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যে সাপ্লাই চেইন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক দেশ তাদের উৎপাদিত খাদ্যপণ্য রপ্তানি করতে পারছে না। বিশ্ববাজারের মােট খাদ্যপণ্যের ৩০ শতাংশই রাশিয়া ও ইউক্রেন সরবরাহ করে থাকে। যুদ্ধের কারণে তা ব্যহত হচ্ছে আর ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে খাদ্য উৎপাদনও ব্যহত হচ্ছে। ইউক্রেনের খাদ্যপণ্যের উপর নির্ভরশীল মিশর, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ নির্ভরশীল। সেসব দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাশিয়া জ্বালানি তেল ও গ্যাসের জোগান বন্ধ বা কমিয়ে দেওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিভিন্ন দেশের খাদ্যপণ্যের মূল্য মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মূল্যস্ফীতিও অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এমন পরিস্থিতি হবে যেখানে ভােক্তারা প্রচুর অর্থ দিয়েও বাজারে গিয়েও চাহিদাকৃত পণ্য ক্রয় করতে পারবে না। অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর প্রভাব ফেলছে। খাদ্য এবং অন্যান্য কতিপয় আমদানির জন্য দেশগুলােকে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে হাত দেওয়া লাগছে। ফলে মুদ্রা রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। অনেক দেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের অন্তত ৯টি দেশের শ্রীলঙ্কার মতাে ঋণখেলাপিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কী থাকবে:
বিশ্বের দুর্ভিক্ষ আসছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা। বর্তমানে অর্থনৈতিক মন্দার আগেই বিশ্বের ৪৮টির মতাে দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ চরম খাদ্য সংকটে রয়েছে। এবং বৈশ্বিক মন্দায় কবলে পড়লে ৩৫ কোটি মানুষ খাদ্য সংকটে পড়বে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক। ইউএনসিটিএডি-এর এক প্রতিবেদন মতে, করােনা এবং চলামান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমান বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং তা ২০২৩ সাল এই অর্থনৈতিক অবস্থা আরাে তীব্র এবং ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। বৈশ্বিক এ অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং বিনিয়ােগ বহুলাংশে কমে যাবে। বিশ্ব বাণিজ্য কমে যাবে। ফলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। বেকারত্ব বেড়ে যাবে।
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাবে। পণ্যমূল্য বাড়বে এবং বর্তমানে তার আঁচও পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশসহ সব দেশে। আমেরিকায় এখন গত ৪০ বছরের মতাে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। বিশ্বব্যাপী মুদ্রার মানে অস্থিরতা চলতে থাকবে। ওইসিডি এর প্রতিবেদন মতে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে অন্তত ২৮ লাখ কোটি ডলারের উৎপাদন হ্রাস পাবে। ফলে সারা বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। গ্যাসের দাম সম্ভাব্য ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। মােট কথা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এসবের প্রভাব পড়ায় সার্বিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারও কমবে।
বাংলাদেশে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব যেমন হবে:
অক্টোবর ২০২২ বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার ৮ টি দেশের মালদ্বীপ এবং আফগানিস্থান বাদে ছয়টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার ভুটান ছাড়া অন্যান্য দেশের রিজার্ভ ঝুকিতে রয়েছে। এ ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর মাঝে বাংলাদেশও রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে রিজার্ভ ৩৪.৩ মার্কিন বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের পরিসংখ্যার ব্যুরোর তথ্য মতে, বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার ১০% কাছাকাছি যা ২০২৩ সালে অস্বাভাবিক হয়ে দাঁড়াতে পারে। ২০২৩ সালের বৈশ্বিক মন্দার কারণে রপ্তানি আয় কমবে।
আমদানি করা খাদ্যদ্রব্য দাম বাড়তে পারে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে পারে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন হতে পারে এবং ডলারসংকট তীব্রতর হতে পারে। পোশাক রপ্তানি কমে যেতে পারে সাথে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে। খাদ্য ঘাটতির শঙ্কাও রয়েছে।
বাংলাদেশের করণীয়:
দেশ ও জাতির সম্ভাব্য এ সংকটে সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার কিছু কিছু পদক্ষেপ ইতিমধ্যে নিয়েছে। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে প্রশাসনিক খরচের লাগাম টানা, উন্নয়নমূলক পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন আপাতত স্থগিতকরণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানো, বিলাস ও প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমাতে এলসি মার্জিন বাড়ানোর মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত। তাছাড়া সরকারের উচিত ডিজেল-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি না করে, প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলেও দাম সহনীয় রাখা। জ্বালানি সংকট উত্তরণে সম্ভাব্য দেশ থেকে তেল এবং এলপিজি গ্যাস আমদানি করা।
কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সকল পতিত জমি চাষের আওতায় আনা। উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে সার ও কীটনাশক বিতরণ এবং বিনা সুদে বা স্বল্প সুদে ঋণ প্রদান। পাশাপাশি কৃষি পণ্য সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত হিমাগার স্থাপন। বিশ্ববাজারে পোশাক রপ্তানিতে বিজিএমআই, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র এক যোগে পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তৎপরতা চালাতে হবে। আমদানি ব্যয় কমানোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ক্রম হ্রাসমান ধারা প্রতিহত করতে হবে। অর্থাৎ আমদানি ব্যয় কমাতে হবে আর রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক বিনিয়োগে বৈদেশিক আর্থিক এবং ব্যবসাহী প্রতিষ্ঠানকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। শুধু সরকার নয় জনগণকেও সঞ্চয়ী হতে হবে মুদ্রার অপচয় রোধে। তবেই দেশ সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কা কাটিয়ে উঠে সুন্দর ভবিষতের দিকে ধাবিত হতে পারবে।
Tags
Essay