Recent Focus Writing 2022: শিল্প খাতে ৪৪ শতাংশ নারী
শিল্প খাতে ৪৪ শতাংশ নারী
দেশে নারীর কর্মসংস্থান বাড়ছে এবং বিশেষ করে এটি হচ্ছে শিল্প খাতে। এই খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৪৪ শতাংশ। সংখ্যার হিসাবে তা ২৪ লাখ চার হাজার ৬৭১ জন। এই নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৫৪.৯২ শতাংশ বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘সার্ভে অব ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিজ’ (এসএমআই) নামের জরিপে উঠে এসেছে এই তথ্য। ২০১৯ সালে সংগ্রহ করা তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। বিসিএস বলছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কর্মপরিবেশের উন্নতি ঘটছে দিন দিন। নারী শ্রমিকের কর্মসংস্থানেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বড় আকারের শিল্প-কারখানায় পুরুষ শ্রমিকের তুলনায় এখন নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। এ ধরনের কারখানার শ্রমিকদের প্রায় ৫৫ শতাংশ নারী। পাশাপাশি শিল্প-কারখানার স্থায়ী শ্রমিকের সংখ্যায়ও নারীরা পুরুষের তুলনায় এগিয়ে।
শিল্প-কারখানায় শ্রমিকদের ৫৯ শতাংশ স্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে। এই স্থায়ী শ্রমিকদের ৬৩.২৪ শতাংশই নারী।
শিল্প খাতে নারীর অগ্রাধিকার তুলে ধরে বিবিএস বলছে, বড় শিল্পে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হলেও অন্য শিল্প-কারখানায় এই হার বেশ কম। মাঝারি আকারের কারখানায় নারী শ্রমিক ২৬.৪৯ শতাংশ। ক্ষুদ্র কারখানায় ১৯.৯৯ শতাংশ। অতিক্ষুদ্র কারখানায় আরো কম। সেখানে ১৮.৯৯ শতাংশ নারী শ্রমিক কাজ করছেন।
জিডিপিতে নারীর অবদান ২০ শতাংশ
২০২০ সালে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় বলা হয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারীর অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। তবে সংসারের ভেতর ও বাইরের কাজের মূল্য ধরা হলে নারীর অবদান বেড়ে দাঁড়াবে ৪৮ শতাংশ। বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, এক কোটি ৮৭ লাখ নারী কৃষি, শিল্প ও সেবা—অর্থনীতির বৃহত্তর এই তিন খাতে কাজ করছে। তবে উৎপাদনব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও নারী কর্মীদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী। তবে শ্রমবাজারে নারীর একটা বড় অংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত। যেমন কর্মজীবী নারীদের অর্ধেকের বেশি কৃষিকাজে সম্পৃক্ত।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিকে (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের
অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদের মতে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর সবচেয়ে বড় বাধা সম্পদের সঙ্গে নারীর সম্পর্কের অভাব। নারীরা যেমন পারিবারিকভাবে সম্পদের সমান ভাগ পান না, তেমনি দেখা যাচ্ছে যে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে গেলেও নারীকে অবহেলার শিকার করতে হয়। তবে এটাও ঠিক, অবস্থার উন্নতি হয়েছে। নারীরা ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন, অনেক নারী ঋণ পাচ্ছেন। অবশ্য অনেক নারীর কাছে এ ঋণপ্রাপ্তি সহজ নয়।
নাজনীন আহমেদ বলেন, শহরের নারীরা যত সহজে ইন্টারনেট কানেকশনসহ নানা সুবিধা পাচ্ছেন, গ্রামের নারীরা তা সহজে পাচ্ছেন না। নারীর অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য বিভিন্ন সম্পদে তাঁর সংযোগ বাড়াতে হবে। পারিবারিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে তা করতে পারলেই নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ অনেক সহজ হবে।
শ্রমশক্তিতে এক কোটি ৮৭ লাখ নারী
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির পটপরিবর্তনে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। স্বাধীনতার পাঁচ দশকে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের সফলতায় বড় অবদান রেখেছেন নারীরা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ, যা পাকিস্তানে ২৩ শতাংশ। বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপে নারী হিস্যা ৩৬.৩ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। ওই জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তিতে যুক্ত পুরুষের সংখ্যা চার কোটি ২২ লাখ আর নারীর সংখ্যা এক কোটি ৮৭ লাখ।
শুধু পোশাক খাতেই যুক্ত ২৩ লাখ নারী
২০২১ সালের এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্টের তথ্য অনুযায়ী, পোশাক খাতে কাজ করছেন ৪০ লাখ শ্রমিক। তার ৫৯.১২ শতাংই নারী। সংখ্যার হিসাবে ২৩ লাখেরও বেশি। তৈরি পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণের শুরু হয় সত্তরের দশকে। শুরুটা হয় ‘রিয়াজ গার্মেন্ট’ দিয়ে। ১৯৭৩ সালে রিয়াজ উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ী এই গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে দেশের বাজারেই বিক্রি হতো এই প্রতিষ্ঠানের তৈরি পোশাক। প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পর ১৯৭৮ সালে প্রথম তাঁরা ফ্রান্সে ১০ হাজার শার্ট রপ্তানি করেন। সেটিই দেশের প্রথম পোশাক রপ্তানি। তখনকার সামাজিক অবস্থা ততটা অনুকূলে না থাকায় রিয়াজ উদ্দিন নিজের মেয়েকেই তাঁর কারখানায় পোশাক তৈরির কাজে লাগিয়ে দেন। এরপর ধীরে ধীরে অন্য নারীরা পোশাকশিল্পের কাজে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিগত ৩০ বছরের ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে পোশাকশিল্পে নারীরা অনেক দূর এগিয়েছেন। তাঁদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, কিন্তু মজুরি বাড়েনি। তাঁরা যে মজুরিতে কাজ করেন, সেটা পুরুষের তুলনায় অনেক কম। মূলত তাঁদের নেওয়াই হয় সস্তা শ্রমের জন্য। তবে কিছু কিছু জায়গায় শ্রমিক সংগঠনের আন্দোলনের কারণে কিছু পরিবর্তন এসেছে। তবে এখনো কারখানাগুলোতে নারীদের কর্মক্ষেত্র নিরাপদ হয়নি। এর জন্য আমাদের আরো লড়াই ও আন্দোলন-সংগ্রাম করতে হবে। ’ পোশাকশিল্পের নারীরা নারী মুক্তির আন্দোলনে বৃহৎ ভূমিকা বলে তিনি মনে করেন। তবে ন্যাশনাল ওয়ার্কার্স ইউনিটি সেন্টারের সভাপতি সুলতানা বেগম মনে করেন, এখনো কারখানাগুলোতে কর্মপরিবেশের তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। নারী শ্রমিকদের সঙ্গে যা-তা ব্যবহার করা হয়।
খুচরা ও পাইকারি খাতে নারী উদ্যোক্তা দুই লাখ
জিডিপির হিসাবের অন্যতম একটি খাত হচ্ছে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা-বাণিজ্য। বিবিএসের করা ‘হোলসেল অ্যান্ড রিটেইল ট্রেড সার্ভে-২০২০’ জরিপ বলছে, এই খাতে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা দুই লাখ তিন হাজার ১৮৯। খাতটিতে সরকারের কোনো না কোনো মাধ্যমে নিবন্ধন রয়েছে, এমন উদ্যোক্তাদের তথ্য শুধু অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জরিপে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে নিবন্ধিত খুচরা ও পাইকারি প্রতিষ্ঠান ছিল ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি। এসব প্রতিষ্ঠানে পুরুষ উদ্যোক্তা ছিলেন এক কোটি ৩৯ লাখ এক হাজার ৫৬৪ জন। তবে নারী উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ট্রাস্ট (উই) বলছে, তাদের নারী গ্রুপে উদ্যোক্তাদের সংখ্যা ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
প্রান্তিক পর্যায়ে নারী উদ্যোক্তাদের বড় বাধা পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ বলে মনে করেন উদ্যোক্তা নবনী চৌধুরী। তিনি তিন বছর ধরে ‘নবনীস প্লেস’ নামের একটি ফেসবুক পেজের মাধ্যমে তাঁর ব্যবসা পরিচালনা করছেন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘নানা বাধার পরেও আমরা নারীরা কোনো না কোনোভাবে সেটাকে ম্যানেজ করেই কাজ করছি। মফস্বল শহরগুলোতে অনলাইনে কাজ করতে গেলে আরো বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। এর মধ্যে অন্যমত হলো পণ্য গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে (ডেলিভারি) সঠিক সরবরাহ ব্যবস্থাপনা না থাকা। পাশাপাশি আছে কাঁচামালের সংকট। ’ পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে নতুন নতুন নারী উদ্যোক্তা তৈরি হবেন বলে তিনি মনে করেন।
Tags
Essay