বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বিষয়াবলী: জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নারী
বাংলাদেশের কয়রা, আশাশুনি, দেবহাটা, শ্যামনগরের নারীরা, যারা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। নদীভাঙনে যারা হারিয়েছেন বাপ-দাদা, স্বামীর ভিটেমাটি। প্রতি বছর নদীভাঙনের কারণে ঘটিবাটি সংসার নিয়ে বার বার সরে যেতে হয় এক বাড়ির উঠোন থেকে আরেক বেড়িবাঁধে। বাড়ির কাছে নদী ছিল, সেখানে ছিল দুটি তেতুঁল আর একটি মিষ্টি আমের গাছ। পুকুরে মাছ ছিল, গরুগুলো তখনও মাঠে। সিডর, আইলা, আম্পানে হারিয়ে গেছে সবকিছু। এমন কাহিনি রাধা রানী, আয়না বিবি, বাসন্তি মুন্ডাদের।
বাসন্তি মুন্ডা (৩২)। বাড়ি কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা সদর ইউনিয়নে। শাখবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধের ওপরেই সংসার পেতেছেন। ২০০৯ সালে আইলায় নদীভাঙনে সবকিছু হারিয়ে তার শ্বশুর-শাশুড়ি এখানে এসেছিলেন। স্বামী মাছ ও কাঁকড়া ধরেন। নিজে একসময় দর্জির কাজ করতেন। এখন বাচ্চা ছোট থাকার কারণে বাড়িতেই থাকছেন। বেড়িবাঁধের অবস্থাও ভালো না। বাঁধ কেটে জমিতে নোনাপানি ঢোকানোর ফলে বাঁধ নড়বড়ে হয়ে গেছে। তিনি বলেন, 'এখানেই আমার বিয়ে হয়েছে। শাশুড়ির কাছে শুনেছি নদীভাঙনে সবকিছু হারিয়ে তারা বাঁধে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাও প্রায় ১৩ বছর হবে। আমরা বাঁধের ওপরেই পড়ে আছি। স্বামী নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরে দিনমজুরি করে কোনো রকমে এই বেড়িবাঁধে মাথা গুঁজে আছি।' আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক মানুষ ঘর পেয়েছেন, ফিরে গেছেন বাঁধের আশ্রয় থেকে। নতুন করে জীবন শুরু করেছেন কিন্তু বাসন্তি মুন্ডারা রয়ে গেছেন বাঁধেই। কেন ফিরে যাননি? এই প্রশ্নের জবাবে বাসন্তি মুন্ডা বলেন, ' আমরা ঘর পাইনি, কারণ নিয়ম অনুযায়ী ঘর পেতে হলে একখণ্ড জমি থাকতে হয়। আমাদের কিছুই নেই। আমাদের ভিটাবাড়ি নদী হয়ে গেছে। আমার বাবা-মায়ের একটু জমি ছিল তাই তারা ঘর পেয়েছেন।'
আপনি আমাদের সাইটে সকল পরীক্ষার প্রশ্ন সমাধান পাবেন. আমরা প্রতিনিয়ত প্রশ্ন সমাধানের আপডেট দিয়ার চেষ্টা করি
আপনি কোন বিষয়ের প্রশ্ন সমাধান খুঁজতে চাইলে আমাদের সার্চ অপসন এ গিয়ে সার্চ করবেন
২.
২০২২ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় 'জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নারী'। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে যে উষ্ণায়ন, পরিবেশের বিপন্নতা তার প্রভাব প্রথম এসে পড়ে নারীর ওপর। পানির স্তর নিচে নেমে যায়, নদীর পানি লবণাক্ত হয়ে যায়, নদী শুকিয়ে যায়, দুই-একটি নলকূপে, যেখানে মিষ্টি পানি ওঠে সেখানেও পানির জন্য হাহাকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করা নাহলে কলসি নিয়ে পানির খোঁজে দীর্ঘপথ হাঁটা। জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে যেতে হয় নারীদের। কারণ লোকালয়ে আর গাছ কোথায়, লবণাক্ত মাটিতে বহুদিন কোনো গাছ জন্মায় না সাতক্ষীরা জেলার এ উপকূলীয় অঞ্চলে। শুধু খাওয়ার পানিই নয়, সংসারে সবকিছুর জন্য যে পানি সেই পানি সংগ্রহ করার দায়িত্বও নারীর। তাই সেই বিপর্যয় মোকাবিলায় নারীকে সামনে দাঁড়াতে হয়।
লবণাক্ততার কারণে ফসল হয় না। কাজের খোঁজে পুরুষকে ঘর ছাড়তে হয়। মেয়েরা রয়ে যায় সন্তান, বয়স্কদের দেখে রাখার দায়িত্বে। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার দায়িত্ব তার। পুরুষ না থাকায় নিরাপত্তাহীনতাও তার। অরক্ষিত জীবন। তারপর হয়তো কখনও গ্রামও ছাড়তে হয়। শহরে বস্তিতে এসে ইটভাটা আর পোশাক কারখানার শ্রমিক হতে হয়। কয়রা ও শ্যামনগর অঞ্চলের নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লবণাক্ত পানি ব্যবহারের ফলে চুল ও ত্বকের ক্ষতি হয়। রং কালো হয়ে যায় ও দ্রুত বার্ধক্য চলে আসে। এছাড়া গর্ভপাত ও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এখানকার উন্নয়নকমী সুপর্ণা সরকার জানালেন, দিনে দুইবার এখানকার নারী ও শিশুরা চিংড়িপোনা ধরার জন্য ভাটার সময় ভোরে ও দিনের বেলায় ফলে প্রায় ৭-৮ ঘণ্টা তাদের লবণাক্ত পানিতে থাকতে হয়। এর ফলে প্রজনন স্বাস্থ্যসহ নারী অন্যান্য স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন।
শিশুরাও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিপন্ন জনগোষ্ঠী। শহরে যেসব শিশু বাসাবাড়িতে কাজ করে তারা বেশিরভাগ নদীভাঙনপীড়িত অঞ্চলের মানুষ। এছাড়া নিরাপত্তাহীনতার কারণে বাঁধের ওপর বাস করা অথবা বাবা কাজের খোঁজে অন্যত্র থাকার কারণে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপ থেকে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে এ শতাব্দী শেষে ৭০ লাখ শিশু পুষ্টিহীনতার অপঘাতে মারা যেতে পারে।
৩.
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমরা অনেক প্রভাব দেখি, এর মধ্যে বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, উষ্ণায়ন ইত্যাদি। সাধারণভাবে বলা যায়- এ প্রাকৃতিক পরিবর্তন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। কিন্তু জলবায়ু বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এইসব দুর্যোগপ্রবণতা বাড়ছে ও উপর্যুপরি হচ্ছে। সিডর, আইলা, আম্পানের মতো দুর্যোগ ফি বছর হচ্ছে। দুর্যোগ যে কেবল সুন্দরবন-সংলগ্ন বা উপকূলীয় অঞ্চলে হচ্ছে তা নয়, সারাদেশেই হচ্ছে, কিন্তু তা ধীরগতির- তাই চোখে পড়ে না সেভাবে। কিন্তু এর প্রভাবে সারাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য, জীবন জীবিকায় প্রভাব পড়ে। মধুপুর অঞ্চলে একসময় ৪৫ হাজার একর প্রাকৃতিক বন ছিল। মধুপুর অঞ্চলের আদিবাসীরা এ বনের ওপর নির্ভরশীল ও কৃষিজীবী ছিলেন। বন বিভাগের তথ্য মতে এখন সাত/আট হাজার একর বনভূমি আছে। ফলে এ অঞ্চলের প্রকৃতিনির্ভর মানুষের অভিবাসন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন পরিচালিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, বর্তমানে মধুপুর অঞ্চলের কর্মক্ষম মানুষের ৮ শতাংশই নারী। যাদের প্রায় ৯৫ ভাগ ঢাকাসহ সারাদেশের বিউটি পার্লারগুলোতে কাজ করছেন। কেবল মধুপুরেই নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামেও এটা হয়েছে। সারাদেশেই জলবায়ুর অভিঘাত জীবন-জীবিকায় কোথাও দ্রুত, কোথাও নীরবে পরিবর্তন ঘটিয়ে চলছে।
৪.
নারীরা পরিবেশের মৌলিক সবকিছুর সঙ্গেই নিয়োজিত থাকেন। স্বাস্থ্য, অধিকারসহ প্রভৃতি জায়গা থেকে তারাই বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। দুর্যোগ সহনশীলতায় নারীকে নাজুক হিসেবে না দেখে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতাকে দেখতে হবে। যেমন নারীরা যে মুঠো চাল সংগ্রহ করে রাখেন, দুর্যোগের সময় এটি অনেক বেশি কাজে লাগে। নারীর এই বহুমাত্রিক ভূমিকা চিন্তা করেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিষয়ে রাষ্ট্রের নীতি গ্রহণ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট রোধে ও মোকাবিলায় নারীরা যে শক্তিশালী ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে এই বিশ্বাস রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় রেখে এ-সংক্রান্ত নীতি গ্রহণ করতে হবে। নারীকে পরিবেশগত ঝুঁকি মোকাবিলায় যত বেশি সংযুক্ত করা যাবে, আমরা তত বেশি লাভবান হবো। কারণ নারীরা ব্যক্তিগত ঝুঁকি ও নাজুকতার মধ্যেও দুর্যোগকালীল তার দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করে যান।
২০২১ সালে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠেয় কপ-২৬ সম্মেলনে 'নারী ও জলবায়ু' শীর্ষক আলোচনায় যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের শিকার সবচেয়ে বেশি হচ্ছেন নারীরা। তাই জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করাও জরুরি। আলোচনায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় করতে উন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রথম জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতীয় কৌশল কর্মপরিকল্পনার দলিল ঘোষণা করে।
জাতীয় কর্মপরিকল্পনা ও কৌশল বাস্তবায়নের জন্য সরকার গঠন করেছে 'বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড', যার চৌদ্দশত কোটি টাকার পুরোটাই সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে দিয়েছে। দ্বিপক্ষীয় অংশীদারদের অর্থায়নে দেশে গঠন করা হয়েছে 'ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলিয়েন্স ফান্ড'। যদিও উন্নয়ন অংশীদারগণ এই ফান্ডের প্রতিশ্রুত অর্থ এখনও ছাড় করেননি। ফলে তহবিলটি কার্যকর হয়নি। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা চালু করেছে। কম কার্বন কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথনির্দেশনা দিতে এটি কাজ করবে।
৫.
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় প্রথমেই উপকূল অঞ্চলে বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এসব অঞ্চলে খাবার পানি কিনে খেতে হচ্ছে, ফলে খাবারের টাকায় টান পড়ছে। নারী ও শিশুর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ঝুঁকিতে পড়ছে। দুর্যোগকালীন এই ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। দুর্যোগ মোকাবিলায় শক্তিশালী খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নীতি-২০২০, বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। জলবায়ু সহিষ্ণু ফসলের যেসব নতুন জাত উদ্ভাবন হচ্ছে তার সুফল নারীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। উৎপাদিত পণ্যের বাজার নিশ্চিত করা ও সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ বাড়াতে হবে। কারণ বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে নারীর আয়ের নিরাপত্তা থাকে না। তাই গতানুগতিক পেশা যেমন কৃষিকাজ, হাঁস-মুরগি পালন ইত্যাদির বাইরে অপ্রচলিত পেশায় নারীকে দক্ষ করে তুলতে হবে। নারী কৃষককে শস্যবীমার আওতায় আনতে হবে। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা/সুরক্ষার পরিধি বাড়াতে হবে, যেখানে ভূমিহীন, আদিবাসী, প্রতিবন্ধীসহ সব বয়স ও শ্রেণিপেশার দুর্বল অবস্থানের নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিতে হবে।
আন্তর্জাতিক মহলে ক্ষতিপূরণ দাবি ও কার্বন নিঃসরণ কমাতে সরকারকে দরকষাকষির দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং একই সঙ্গে জনগণের অংশগ্রহণে জলবায়ু তহবিলের স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত নারীর অনুদানের অর্থ সরাসরি নারীর হাতে দিতে হবে। তার জন্য মোবাইল ব্যাকিং করা যেতে পারে। কারণ বেশিরভাগ নারীরই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকে না। তাই নারীর এ অর্থ থেকে বঞ্চিত হবার সুযোগ থেকে যায়।
৬.
যেকোনো প্রাকৃতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তন ও সময় নারীর দিকে একটা একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। পাশাপাশি দেশের সব অঞ্চলের জলবায়ু বিপন্নতার মাত্রা ধরন এক নয়। তাই নারীর জলবায়ু সহনশীলতা বাড়ানো ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলায় নারীর সক্ষমতা বাড়াতে হলে এই বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা মাথায় রাখতে হবে। ২০২১ সাল পার হয়েছে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ কোনো কার্যকর চুক্তিতে উপনীত হতে পারেননি। এমনকি উন্নত দেশগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর যে অঙ্গীকার করেছিল তাও যথাযথভাবে পালন করেনি। অনেক তো হলো মানবিকতার ভাষ্য/ পৃথিবীটা তবু একচুলও এগোলো না এবার তাহলে মানবিকতাই হোক/ একুশ শতকে স্বপ্টম্ন দেখার চোখ (মেয়েদের অ আ ক খ- মল্লিকা সেনগুপ্ত)।