বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের প্রভাব - বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করােনার প্রভাব 2021


বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনা ভাইরাসের প্রভাব - বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করােনার প্রভাব 


২০২০ সালের গােড়ার দিকে করােনাভাইরাসের উৎপত্তি হলেও ফেব্রুয়ারি মাসে এ ভাইরাস ইউরােপআমেরিকাসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ৮ ই মার্চ বাংলাদেশে করােনাভাইরাসের রােগী প্রথম ধরা পড়ে। ক্রমান্বয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানেও এর প্রকোপ অব্যাহত রয়েছে। সরকারি হিসেবে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কোভিড-১৯ আক্রান্ত রােগীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৫০ হাজারের উর্দ্ধে আর মৃত্যুর সংখ্যা ২৭ হাজারেরও বেশি। অন্যদিকে সুস্থ হয়েছে ১৫ লাখ ১০ হাজারেরও বেশি আক্রান্ত ব্যক্তি।


করােনাকালীন সরকারি ছুটি এবং লকডাউনের কারণে দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এখন ক্রমান্বয়ে শিক্ষাসহ সবকিছু খুলে দেওয়া হলেও দেশের অর্থনীতিতে কয়েক দফার লকডাউন এবং সরকারি ছুটির প্রভাব এখনাে রয়েছে।


বাংলাদেশের অর্থনীতির দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানাে রেমিটেন্স। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশে কর্মরত ১০ মিলিয়ন বাংলাদেশী কর্মী ১৮ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠায়। সৌদি আরব, ইতালি। এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে করােনার প্রকোপ থাকায় বৈদেশিক টাকা পাঠানাের ক্ষেত্রে ধস নামার কথা। থাকলেও তা হয়নি। 


মূলত বৈধ উপায়ে টাকা পাঠানাে, করােনাকালীন সময়ে পরিবারকে বেশি টাকা পাঠানাের কারণে সৌভাগ্যবশত বরং তা বেড়েছে যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ২৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। তবে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নেতিবাচক হবে।

আমাদের রপ্তানির আয়ের প্রায় ৮৪ শতাংশ আসে গার্মেন্টস শিল্প থেকে। এ শিল্পে প্রায় ৪.৫ মিলিয়ন লােকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই শিল্প টিকে আছে মূলত ইউরােপ এবং আমেরিকার বাজারের উপর নির্ভর করে। কিন্তু করােনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের কারণে অনেক পশ্চিমা ক্রেতা দেশ তাদের অডার বাতিল কিংবা স্থগিত করে। টাকার মূল্যে এর পরিমাণ ১.৫ বিলিয়ন ডলার। অন্যান্য দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নাজুক হওয়ায় রপ্তানি প্রবাহ এখনাে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসেনি।


২০১৯-২০২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশের উর্দ্ধে থাকলেও অর্জিত হয়েছে ৫.২৪। শতাংশ, যা বৈশ্বিক তুলনায় সন্তোষজনক বলা যায়। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ ২০২০-২০২১ সালে বাংলাদেশে ডিজিপি প্রবৃদ্ধি ৪.৪০ শতাংশ নির্ধারণ করেছিল আর সরকারের প্রত্যাশা ছিল ৮.২। তবে বাংলাদেশ ৫.৮৭ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যা বৈশ্বিক বিচারে সস্তোষজনক।


বাংলাদেশ হাউজহােল্ড ইনকাম এন্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভের তথ্যর মতে, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর কারণে বাংলাদেশের দরিদ্রতার হার ২০০৫ সালের ৪০.৯ শতাংশে এ চলে যেতে পারে। কোভিড-১৯ এর কারণে বর্তমানে ২০.৫ শতাংশ। বিভিন্ন অর্থনীতির কর্মকাণ্ডের কারণে দরিদ্রতার প্রভাব বিভিন্ন হবে বলে গবেষকরা মনে করছে। অন্য একদল গবেষক জানিয়েছে বাংলাদেশে ৪৩ শতাংশ নতুন দরিদ্র জনগােষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে যারা নিজেদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়াবে। 


আরেক পরিসংখ্যান মতে, চরম দরিদ্রতার হার ৬০% বৃদ্ধি পেয়েছে আর তাদের ১৪ শতাংশের বাড়িতে কোনাে খাবার নেই। পরিসংখ্যান মতে, সাধারণ ছুটি এবং এলাকাভিত্তিক লকডাউন এবং সামাজিক দুরত্বের কারণে ৭৩% লােকের কাজ হারানাে বা কম কাজের সুযােগ থাকছে। বিআইডিএসের এক জরিপে জানানাে হয় যে, প্রায় ১ কোটি ৬৮ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়ে যায়। অকৃষিভিক্তিক পেশার মানুষের মাঝে এ কাজ হারানাের হারটা অনেক বেশি। তাছাড়া বিভিন্ন পেশা রিক্সা চালক, শিল্পকারখানার কর্মী, রেস্টুরেন্ট কর্মী আর দিন মজুরের আয় অনেক কমে গেছে।


অপ্রাতিষ্ঠানিক ও স্বউদ্যোগী ব্যবসা, হোঁটেল-রেস্তোরা, গণপরিবহন, বিমান পরিবহন, পর্যটন প্রভৃতি খাত ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বেশি। কর্মসংস্থান হারিয়েছে অনেকে। কর্মসংখ্যান হারানাের এ সংখ্যা বা পরিমাণ প্রায় ২০ শতাংশ। নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্য-কেনা বেচা এবং জরুরি সেবাখাত ব্যতীত সেবাখাত দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। সব ধরনের যােগাযােগ, পর্যটন, হােটেল ও রেস্টুরেন্ট, রিয়েল ইস্টেটসহ সকল প্রকার সেবা খাত দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। সব মিলিয়ে সেবাখাতের ক্ষতির পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা।


করােনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দীর্ঘদিন সকল সেক্টর বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং খাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অ্যাসােসিয়েশন অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশ (এবিবি) এর আশংকা অনুসারে প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের বাৎসরিক আয় ১৫০ কোটি টাকা কমে যাবে। বর্তমানে অনেক ব্যাংক তাদের কর্মীদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছে। বেতন ভাতা কমানাে, কর্মী ছাঁটায়, নতুন জনবল নিয়ােগ না দেওয়া, বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণের মতাে অনেক সিদ্ধান্তও নিয়েছে অনেক ব্যাংক। তবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিকের দিকে যাওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে।


অর্থনৈতিক অবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলাে দেশের আমদানি-রপ্তানি। করােনার কারণে দেশে ব্যবসা মন্দা হওয়ায় আমদানি রপ্তানিতে ধস নামে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি কমে ৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। মহামারীর প্রকোপ, মৃত্যুহারের আধিক্য, লকডাউন ও ব্যবসা মন্দার কারণে অনেক রফতানি আদেশ স্থগিত হয় ও রফতানি কমে যায়। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে রপ্তানি-আমদানির মাঝে ব্যবধান ২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি।


বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঘনবসতিপূর্ণ কৃষি নির্ভর একটি দেশ। এ দেশের ৪০ শতাংশ মানুষই প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। কিন্তু করােনার প্রকোপ থেকে এই খাতটিও রক্ষা পায়নি। লকডাউনের কারণে পচনশীল দ্রব্য গণপরিবহনের অভাবে পঁচে নষ্ট হয়েছে বিদেশেও অনেক কিছু রপ্তানি করা সম্ভব হয়নি। ফলে ক্ষতি হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা।

Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post

Contact Form